ডা. ওয়াজেদ খান : | বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটেছে স্বৈরাচারের। গঠিত হয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আন্দোলনকারীরা অঙ্গীকার করেছেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কারের। গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা স্বৈরাচারমুক্ত একটি বৈষম্যহীন, মানবিক, কল্যাণকর ও আইনের শাসনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এজন্য রাষ্ট্রসংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শতমুখী পরিকল্পনা নিয়ে সবকিছুর সংস্কার করতে পারবে না। তবে কিছু বিষয়ের পুরোটাই, কিছু বিষয়ের আংশিক এবং সংস্কার করতে হবে কিছু বিষয়ের সবটাই। সংবিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, আইন, বিচার, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে দিতে হবে অগ্রাধিকার। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেন রাজনীতিকরা। দিনশেষে সব দায় বর্তায় তাদেরই ওপর। এ কারণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার। অপরাজনীতির কারণে অর্ধশতাব্দীকালেও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বাংলাদেশে। বারবার উত্থান ঘটেছে স্বৈরাচারের। সরকার বদলেছে, কিন্তু মৌলিক গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি রাজনীতিতে। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার ছিটেফোঁটাও নেই। করপোরেট কায়দায় নেতৃত্বের নিয়োগ-পদায়ন চলে দলগুলোয়। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দ্বারা নেতৃত্ব বাছাইয়ের পথ রুদ্ধ।
যুগের পর যুগ ধরে আঁকড়ে রাখা শীর্ষ নেতৃত্ব যাকে খুশি তাকে নেতা বানান, মনোনয়ন দেন নির্বাচনে। এজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হয় না দলের নেতাকর্মীদের কাছে। নেতৃত্ব লাভের যোগ্যতা ও মাপকাঠি চাটুকারিতা ও বিত্তবৈভব। এসব কারণে বড় দলগুলোয় বিগত দুদশকে গড়ে ওঠেনি নতুন কোনো নেতৃত্ব। দলীয় প্রধানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ও ব্যক্তিপূজা দলের অভ্যন্তরে শীর্ষ নেতৃত্বকে এভাবেই করে তোলে স্বেচ্ছাচারী। ফলে এসব ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন, তখন তারা পরিণত হন স্বৈরাচারে।
ভবিষ্যতে স্বৈরশাসন রোধ করতে হলে চিহ্নিত করতে হবে স্বৈরাচারের উৎপত্তি ও উত্থানের উৎসমুখ। রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে হঠাৎ করেই কোনো ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে না।
সামরিক স্বৈরাচারের বিষয়টি ভিন্ন হলেও বেসামরিক স্বৈরাচার গড়ে ওঠে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে। আর এসব স্বৈরাচারের উৎপত্তি নিজ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব থেকেই। সবকিছু নির্ধারিত হয় শীর্ষ নেতৃত্বের পছন্দ ও অপছন্দের ওপর ভিত্তি করে। দলের অভ্যন্তরে তার ওপরে কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। উপরন্তু তিনি যা বলেন, তাতেই তারা দেন বাহবা। স্তাবক ও তোষামোদকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন শীর্ষ নেতাকে। তিনি হয়ে ওঠেন মাননীয়-পূজনীয়। এমন একটি রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়, তখন সেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী। কব্জা করে ফেলেন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের সবকিছুই পরিচালিত হয় তার নির্দেশে। মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই স্বৈরাচার সৃষ্টির সূতিকাগার, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শেখ হাসিনা।
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় টানা ৪৩ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ এ সময়কালে হাসিনার অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব দলে তাকে করে তোলে স্বৈরাচারী। শেখ পরিবারের নামে তিনি বিনা ভোটে পাঁচবারের মতো শপথ নেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বড় দুটি দলের অবস্থাও তথৈবচ। এসব দলেও যুগের পর যুগ ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে একই পরিবার।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পরিবারতান্ত্রিকতা এখনো চলছে। রাজতন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ পরিবারতন্ত্র মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে মূল্যায়ন নেই মেধা ও যোগ্যতার, যে কারণে বড় রাজনৈতিক দলগুলোয় দেখা মিলছে না মেধাবী নেতৃত্বের। রাজনীতির তৃণমূল পর্যায়েও বিস্তৃতি ঘটেছে পরিবারতন্ত্রের। কোনো একজন সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে সেই আসনে শূন্যতা পূরণ করছে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী বা সন্তানদের কেউ।
এভাবেই নাগরিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সক্ষমতা খর্ব হচ্ছে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে। গণতন্ত্র ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি একই সমান্তরালে চলতে পারে না। রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতেই বিশ্বে বড় বড় সব বিপ্লব ঘটিয়েছে মানুষ। বন্ধ করে দিয়েছে বংশ পরম্পরায় ব্যক্তিপূজা অনুশীলন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারমুক্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে, যার সঙ্গে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি বেমানান। রাজনীতির চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রে স্বৈরাচারের পুনরুত্থান হতেই থাকবে। সময় এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে এসে মেধাভিত্তিক রাজনীতিচর্চার।
যেসব দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই, শীর্ষ নেতৃত্বের জবাবদিহি নেই, সেসব দল রাষ্ট্রে কীভাবে গণতন্ত্র কায়েম করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। স্বার্থের কারণেই রাজনীতিকরা নিজ থেকে কখনোই আগ্রহী হবে না রাজনৈতিক সংস্কারে।
এজন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারকে প্রথমেই সম্পন্ন করতে হবে রাজনৈতিক সংস্কারের কাজটি। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া টেকসই হবে না অন্য কোনো সংস্কার। একমাত্র রাজনৈতিক সংস্কার এবং সমঝোতাই পারে চলমান সংকট থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে। অতীতমুখী সংকীর্ণ ও কার্যত নিষ্ক্রিয় বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে পরিচয় দিয়েছে ব্যর্থতার। সরকারি দলের ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং বিরোধী দলের ক্ষমতায় আরোহণের প্রতিযোগিতা চলছে নিরন্তর। ফলে রাজনৈতিক দলের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না জনগণ। তরুণ প্রজন্ম এখন রাজনীতিকে দেখছে ঘৃণার চোখে। রাজনীতির প্রতি শিক্ষিত দেশপ্রেমিক শ্রেণির মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে নির্লিপ্ততা। মোট কথা নির্বাচন হলে বা সরকার বদলালেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আসবে না কোনো পরিবর্তন। দেশ আবারও নিপতিত হবে গভীর সংকটে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে রাজনৈতিক সংস্কার কাজে। এখনই তাদের অস্থির হলে চলবে না নির্বাচনের জন্য। নির্বাচন হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না, প্রাতিষ্ঠানিকতা পায় না গণতন্ত্র। জাতীয় সংসদের ১২টি নির্বাচনের পর এমন কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় সংস্কার ছাড়া কোনো সুযোগ নেই তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক সংস্কারের
উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ—
১. দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সুযোগ দিতে হবে নেতৃত্ব বাছাইয়ের।
২. অবসান ঘটাতে হবে পরিবারতান্ত্রিক ব্যক্তিপূজার রাজনীতির। দুই মেয়াদের বেশি থাকা যাবে না শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে।
৩. কেউ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
৪. শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্দলীয় ছাত্র সংসদ এবং শিক্ষকদের পেশাজীবী সংগঠন থাকবে নিজেদের অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের জন্য।
৫. দল নিরপেক্ষভাবে জনসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও সরকারি-আধা সরকারি প্রশাসনের কোনো পর্যায়েই দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না। এক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করবে।
৬. আদালতে আইন ব্যবসায়ী পেশাজীবী সংগঠন ছাড়া এবং জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও শিল্পকারখানায় দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে তাদের ক্ষেত্রে নির্দলীয় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ থাকবে।
৭. বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা কমিটি গঠন নিষিদ্ধ করতে হবে।
৮. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেউই একাধিক আসনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
৯. নৈতিক স্খলন, দুর্নীতি ও অপরাধজনিত কারণে আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
১০. কোনো রাজনৈতিক দল মনোনয়ন বাণিজ্যে লিপ্ত বলে প্রমাণিত হলে নির্বাচন কমিশন সেই দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারবে।
১১. প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের কোনো সদস্য একই সময় দলের নির্বাহী পদে আসীন থাকতে পারবেন না। রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রচলিত এই টু-ইন-ওয়ান পদ্ধতি বিলুপ্ত করতে হবে।
১২. সরকারি অফিস-আদালত ও বাসভবনে দলীয় সভা-সমাবেশ করা যাবে না।
Posted ১১:০১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh